জীবনধারণের জন্য খাদ্য অপরিহার্য। খাদ্য থেকে প্রাপ্ত পুষ্টি উপাদানগুলোই আমাদের দেহে বিভিন্ন কাজ করে থাকে। আমাদের শরীরে খাদ্য গ্রহণের ফলে যে কাজগুলো সম্পন্ন হয় তা হলো—
১। দেহ গঠন ও বৃদ্ধি সাধন
২। ক্ষয় পূরণ
৩। তাপ উৎপাদন ও কর্মশক্তি প্রদান
৪। দেহের অভ্যন্তরীণ কার্যাদি নিয়ন্ত্রণ
৫। রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা তৈরি
১। দেহ গঠন ও বৃদ্ধি সাধন- খাদ্যের মধ্যে অবস্থিত প্রোটিন দেহ গঠনের কাজ করে থাকে। শিশুর শরীর গঠনের জন্য পুষ্টি উপাদান গুরুত্বপূর্ণ। একটি মাত্র কোষ থেকে মায়ের পেটে শিশুর বৃদ্ধি ঘটে। কোষ পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ২টি কোষে বিভক্ত হয়। এভাবে আবার নতুন কোষ সৃষ্টি করে এবং পরবর্তীতে লক্ষ লক্ষ কোষ এবং আরও পরে কোটি কোটি কোষের সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ মানব শিশুর জন্ম হয়। গর্ভাবস্থায় শিশুর বৃদ্ধির জন্য পুষ্টির প্রয়োজন হয়, অর্থাৎ খাদ্যের কাজ হলো শরীর গঠনের মাধ্যমে বৃদ্ধি সাধন করা। খাদ্যের মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান এই কাজগুলো সম্পন্ন করে থাকে। -
২। ক্ষয় পূরণ – প্রতিনিয়তই আমাদের শরীর ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে, আর এই ক্ষয়প্রাপ্ত দেহ পুনর্গঠন করার কাজও খাদ্যের। প্রতিনিয়তই পুরনো কোষের মৃত্যু ঘটে যার ফলে কিছু পুষ্টি উপাদান শরীর থেকে বের হয়ে যায় আর কিছু পুষ্টি উপাদান শরীরে থেকে যায় যা নতুন কোষ গঠনে অংশ নেয়। খাদ্য থেকে প্রাপ্ত পুষ্টি উপাদানের সাথে ওইগুলো যুক্ত হয়ে নতুন কোষ গঠনে সহায়তা করে। আমরা যদি একজোড়া জুতা ক্রমাগত পরতে থাকি, তাহলে তার তলা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। একসময় তা ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যায়। কিন্তু জুতা ছাড়া যদি হাঁটা হয় তাহলে কিন্তু পায়ের তলা জুতার মতো ক্ষয় হয়ে যায় না। কারণ প্রতিনিয়তই মৃত কোষ বা ক্ষয়প্রাপ্ত কোষগুলোর জায়গায় নতুন কোষ তৈরি হচ্ছে এবং ক্ষয়পূরণের কাজ সম্পন্ন হচ্ছে। এভাবে অসুস্থ থাকার পর বা আঘাতপ্রাপ্ত হলে নতুন কোষ তৈরির মাধ্যমে ক্ষতস্থানের ক্ষয়পূরণ ঘটে। তাই প্রত্যেক মানুষের শরীরেই খাদ্য হতে প্রাপ্ত পুষ্টি উপাদানগুলো এই ক্ষয়পূরণের কাজ করে শরীরকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করে।
দেহ গঠন ও বৃদ্ধি সাধন
ক্ষয় পূরণ ←
দেহের অভ্যন্তরীণ কার্যাদি নিয়ন্ত্রণ
খাদ্যের কাজ
তাপ উৎপাদন ও কর্মশক্তি প্রদান
রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা তৈরি
খাদ্যের কাজ
৩। তাপ উৎপাদন ও কর্মশক্তি প্রদান-একটি গাড়ির ইঞ্জিন চালানোর জন্য জ্বালানি হিসেবে পেট্রল বা গ্যাসের - প্রয়োজন হয়। এই জ্বালানি পুড়ে শক্তি তৈরি হয়, যার ফলে গাড়ি চলতে পারে। আমাদের শরীরকেও এই গাড়ির ইঞ্জিনের সাথে তুলনা করতে পারি। আমাদের শরীরে খাদ্যের মাধ্যমে প্রাপ্ত পুষ্টি উপাদানগুলো শরীরের কোষে জ্বালানির মতো পুড়ে শক্তি তৈরি করে। ফলে আমরা সচল আছি এবং বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে পারছি। খাদ্য থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান আমাদের শরীরে যে তাপশক্তি উৎপন্ন করে, তার ফলে আমরা কাজ করার ক্ষমতা অর্জন করি। বেঁচে থাকার জন্য রক্ত সঞ্চালন, শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ, খাদ্যের পরিপাক এবং মল-মূত্র ত্যাগ ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় কাজ, যা সম্পাদন করতে শক্তির প্রয়োজন। যখন আমরা ঘুমিয়ে থাকি তখনও শক্তি খরচ হয়। শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা রক্ষার জন্য, টিসু গঠনের জন্য, শরীরের বিভিন্ন তরল তৈরি, মায়ের দুধ তৈরি, সব ধরনের অভ্যন্তরীণ কাজের জন্য শক্তি প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া চলাফেরা, খেলাধুলা, কথা বলা এবং সব রকমের বাহ্যিক কাজের জন্যও শক্তির প্রয়োজন।
৪। দেহের অভ্যন্তরীণ কার্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে -আমাদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে থাকে, যার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন হয়। খাদ্য গ্রহণের পর যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে থাকে তা হলো- শক্তি উৎপাদণের জন্য পুষ্টি উপাদান পুড়ে, পেশির সঞ্চালনের জন্য শক্তি ব্যবহৃত হয়, নতুন কোষ গঠন করে,বিভিন্ন ধরনের দেহ তরল উৎপাদন ও নিঃসরণ হয় ইত্যাদি। এই প্রক্রিয়াগুলোকে সম্পাদন করতে কিছু কিছু পুষ্টি উপাদান গুরুত্বপূর্ণ, যেমন- খাদ্যের ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স, খনিজ লবণ, প্রোটিন ও পানি এগুলো বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া সংগঠিত করার কাজে সহায়তা করে। এ ছাড়া শরীরের বিভিন্ন এনজাইম ও হরমোন উৎপাদনে বিভিন্ন প্রোটিন ও ধাতব লবণের ভূমিকা রয়েছে। এই এনজাইম ও হরমোনগুলো শরীরের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিক্রিয়া বা প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। অর্থাৎ দেহের অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে ও বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় খাদ্যের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
৫। রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা তৈরি – প্রতিদিনই আমাদের শরীর বিভিন্ন ধরনের অণুজীব দিয়ে বা সংক্রামক - ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। এই আক্রমণের হাত থেকে শরীরকে রক্ষা করার জন্য চাই শরীরের নিজস্ব স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা। আর বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের ফলে এই রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা অর্জিত হয়। খাদ্যের প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজ লবণ দেহের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা অর্জনে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণে শরীর সহজেই সুস্থ থাকে অর্থাৎ শরীরের সঠিক সুস্থতা রক্ষা হয়। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে অপর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে পুষ্টির অভাব দেখা দেয়। পুষ্টির অভাবে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কমে যায় এবং বিভিন্ন ধরনের রোগের লক্ষণ দেখা যায় এবং সহজেই অসুস্থ হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হলে কিছু কোষের মৃত্যু ঘটে এবং কখনো কখনো টিসুগুলো ধ্বংস হতে পারে। শরীরে নতুন কোষ গঠনের মাধ্যমে টিসুর ক্ষয়পূরণ করে থাকে, এক্ষেত্রে শক্তি, প্রোটিন এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের প্রয়োজন হয়।
উপরের আলোচনা থেকে একথা বলতে পারি যে, খাদ্য শুধু ক্ষুধাই নিবৃত করে না, শরীরে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পাদন করে থাকে। তাই শরীর সুস্থ রাখতে হলে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণ করা উচিত।
কাজ – বিভিন্ন ধরনের খাদ্য আমাদের শরীরে কী কী কাজ করে থাকে তা ক্রমানুসারে সাজিয়ে লেখ ।
খাদ্যকে ভাঙলে বিভিন্ন ধরনের জৈব রাসায়নিক বস্তু পাওয়া যায়। খাদ্যের মধ্যে যেগুলো আমাদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের কাজ সম্পাদন করে শরীরকে সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম রাখে তাদের পুষ্টি উপাদান বা খাদ্য উপাদান বলে। এই পুষ্টি উপাদানগুলো আমাদের দেহে বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। খাদ্যের মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানগুলো প্রধানত ছয় প্রকার। যথা—
(১) প্রোটিন
(২) কার্বোহাইড্রেট
(৩) ফ্যাট
(৪) ভিটামিন
(৫) ধাতব লবণ
(৬) পানি
এগুলো আমাদের শরীর গঠন, রক্ষণাবেক্ষণ ও তাপশক্তি উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। খাদ্য থেকে প্রাপ্ত ছয়টি পুষ্টি উপাদানের প্রতিটিই আমাদের দেহে একাধিক কাজ করে থাকে। আমরা এই ছয়টি পুষ্টি উপাদান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
প্রোটিন
‘প্রোটিন' শব্দটা গ্রিক শব্দ প্রোটিওজ থেকে এসেছে। এর অর্থ হলো সর্বপ্রথম অবস্থান। যেখানেই প্রাণের অস্তিত্ব সেখানেই থাকে প্রোটিন। তাই প্রোটিন ছাড়া কোনো প্রাণির অস্তিত্ব কল্পনা করা সম্ভব না। প্রাণি এবং উদ্ভিজ জগতে প্রোটিন একটা প্রধান অংশ। এজন্য প্রোটিনকে মূখ্য উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রোটিনের গঠন সব প্রোটিনই কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেন নিয়ে গঠিত। কোনো
কোনো ক্ষেত্রে সালফার, ফসফরাস, লৌহ ইত্যাদি মৌলিক পদার্থ যুক্ত থাকে। প্রোটিনকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে
ভাঙলে প্রথমে অ্যামাইনো এসিড এবং পরে কার্বন, হাইড্রোজেন ইত্যাদি মৌলিক পদার্থ পাওয়া যায় ৷
অ্যামাইনো এসিড – বড় আকারের এক একটা প্রোটিনকে আর্দ্র বিশ্লেষিত করলে কতকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এসিড অণু পাওয়া যায়। এদের প্রত্যেকটা অণুতে কমপক্ষে একটা অ্যামাইনো দল (–NH2) ও একটা কার্বক্সিল দল (–CooH) বিদ্যমান থাকে। এদের অ্যামাইনো এসিড বলে। অ্যামাইনো এসিডগুলোর প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে এদের দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা— অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিড ও অনাবশ্যক অ্যামাইনো এসিড।
অ্যামাইনো এসিড
অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিড
অনাবশ্যক অ্যামাইনো এসিড
ক) অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিড – কতোগুলো অ্যামাইনো এসিড আমাদের শরীরে তৈরি হয় না ফলে এই অ্যামাইনো এসিডগুলোর প্রয়োজন মিটানোর জন্য খাদ্যের মাধ্যমে সরবরাহ করতে হয়। এই সমস্ত অ্যামাইনো এসিডকে অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিড বলে।
খ) অনাবশ্যক আমাইনো এসিড -কতোগুলো অ্যামাইনো এসিড আমাদের শরীরে তৈরি হয় ফলে এই অ্যামাইনো এসিডগুলোর প্রয়োজন মেটানোর জন্য খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহণ না করলেও কোনো সমস্যা হয় না। ওই সমস্ত অ্যামাইনো এসিডকে অনাবশ্যক অ্যামাইনো এসিড বলে।
প্রোটিনের শ্রেণি বিভাগ
(ক) উৎস অনুযায়ী শ্রেণি বিভাগ -
উৎস অনুযায়ী প্রোটিনকে ২ ভাগে ভাগ করা যায় (১) প্রাণিজ প্রোটিন – যে প্রোটিনগুলো প্রাণিজগৎ থেকে পাওয়া যায় তাকে প্রাণিজ প্রোটিন বলে। যেমন- মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি প্রাণিজ প্রোটিন।
(২) উদ্ভিজ্জ প্রোটিন - উদ্ভিজ জগৎ থেকে প্রাপ্ত প্রোটিনকে উদ্ভিজ্জ প্রোটিন বলে। যেমন- ডাল, বাদাম, সয়াবিন, সিমের বিচি ইত্যাদি খাদ্যের উদ্ভিজ্জ প্রোটিন।
(খ) অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিডের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে শ্রেণিবিন্যাস - অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিডের পরিমানের ওপর ভিত্তি করে ৩ শ্রেণিতে ভাগ করা হয় ।
(১) সম্পূর্ণ বা প্রথম শ্রেণির প্রোটিন – যে সব প্রোটিনে অত্যাবশকীয় অ্যামাইনো এসিডগুলো দেহের প্রোটিন - গঠনের উপযোগী অনুপাতে বর্তমান থাকে সেই প্রোটিনকে সম্পূর্ণ প্রোটিন বা প্রথম শ্রেণির প্রোটিন বলে। মাছ, মাংস ইত্যাদি প্রাণিজ প্রোটিনে অত্যাবশ্যক অ্যামাইনো এসিডগুলো দেহের প্রোটিন গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণে বর্তমান থাকে। এই জন্য এই প্রাণিজ প্রোটিনগুলো সম্পূর্ণ বা প্রথম শ্রেণির প্রোটিন।
(২) আংশিক পূর্ণ বা দ্বিতীয় শ্রেণির প্রোটিন – কোনো কোনো প্রোটিনে একটা বা দুইটা অত্যাবশ্যক অ্যামাইনো - এসিড দেহ গঠনের জন্য উপযোগী অনুপাতে থাকে না ফলে দেহের বৃদ্ধি ব্যহত হয়। এই সব প্রোটিনকে কম উপযোগী বা আংশিক পূর্ণ বা দ্বিতীয় শ্রেণির প্রোটিন বলে। যেমন—চাল, ডাল, আটা, বাদাম, আলু ইত্যাদি বিভিন্ন উদ্ভিদজাত প্রোটিনে অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিডগুলো কম পরিমাণে থাকে। যেমন- ডালে মেথিওনিন, চালে লাইসিনের পরিমাণ কম থাকে ।
(৩) অসম্পূর্ণ বা তৃতীয় শ্রেণির প্রোটিন- যে প্রোটিনে দেহের চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় সকল অ্যামাইনো এসিডগুলো পরিমিত পরিমাণে বিদ্যমান থাকে না সেগুলোকে অসম্পূর্ণ প্রোটিন বলে। যেমন— ভূট্টার প্রোটিন জেইন (Zein)।
প্রোটিনের উৎস-
প্রাণিজ প্রোটিন- মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, পনির, ছানা ইত্যাদি ।
উদ্ভিজ্জ প্রোটিন – বিভিন্ন ধরনের ডাল, সয়াবিন, বাদাম, চাল, গম ইত্যাদিতে প্রোটিন পাওয়া যায় ।
প্রোটিনের কাজ
১। দেহ গঠন ও বৃদ্ধি সাধন - প্রোটিনের প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে দেহ কোষের গঠন ও বৃদ্ধি সাধন করা আমাদের দেহের অস্থি, পেশি, বিভিন্ন দেহযন্ত্র, রক্ত কণিকা হতে শুরু করে দাঁত, চুল, নখ পর্যন্ত প্রোটিন দিয়ে তৈরি।
২। ক্ষয় পূরণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে আমাদের কোষগুলি প্রতিনিয়তই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এই ক্ষয়প্রাপ্ত স্থানে - নতুন কোষ গঠন করে ক্ষয়পূরণের কাজ করে প্রোটিন। কোনো ক্ষতস্থান সারাতেও প্রোটিনের ভূমিকা রয়েছে।
৩। তাপশক্তি উৎপাদন -১ গ্রাম প্রোটিন থেকে ৪ কিলোক্যালরি শক্তি উৎপন্ন হয়। যখন দেহে ফ্যাট ও - কার্বোহাইড্রেটের ঘাটতি থাকে তখন প্রোটিন তাপ উৎপাদনের কাজ করে থাকে।
৪। দেহের রোগ প্রতিরোধক শক্তি অর্জন - বাইরের বিভিন্ন রোগজীবাণু নানা ভাবে আমাদের দেহে প্রবেশ করে নানা রকমের রোগব্যাধি জন্মাতে পারে। এইসব রোগ-জীবাণুকে প্রতিরোধ করার জন্য দেহে তাদের বিরোধী পদার্থ বা এন্টিবডি তৈরি করা প্রোটিনের একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ।
৫। মনন শক্তির বিকাশ - মানসিক বিকাশেও প্রোটিন অপরিহার্য। মানসিক বিকাশ বা মস্তিস্কের বিকাশের - সময় প্রোটিনের অভাব হলে বুদ্ধির বিকাশ ব্যহত হয়।
৬। দেহাভ্যন্তরের কাজ নিয়ন্ত্রণ – প্রোটিন দিয়ে তৈরি এনজাইম, হরমোন, ইত্যাদি দেহাভ্যন্তরের বিভিন্ন
কাজকর্ম সুপরিচালিত করে থাকে।
৭। প্রয়োজনীয় উপাদান পরিবহন করে- রক্তের প্রোটিন হিমোগ্লোবিন বাতাস থেকে প্রাপ্ত অক্সিজেন গ্রহণ করে শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রেরণ করে।
৮। দেহে পানির সমতা রক্ষা করে- প্লাজমা বা রক্তের প্রোটিন দেহে পানির সমতা বজায় রাখে ।
অভাবজনিত লক্ষণ—
শিশুর খাদ্যে প্রোটিনের অভাব হলে-
দেহের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় । ওজন কমে যায় ৷
•চামড়া খসখসে হয়।
• চুলের রং ফ্যাকাশে হয় ।
মেজাজ খিটখিটে হয় ।
• মানসিক বিকাশ পিছিয়ে পড়ে।
প্রোটিনের ঘাটতিতে এনজাইমের সংশ্লেষণ কমে যায়
• খাদ্য ঠিকমতো পরিপাক হয় না, বদহজম হয়।
রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কমে যায়।
প্রাথমিক পর্যায়ে এই লক্ষণগুলো দেখা দেয়, যাকে প্রাক– কোয়াশিয়রকর অবস্থা বলে
যদি এই অবস্থা চলতে থাকে তাহলে শিশুর উপরের লক্ষণগুলের পাশাপাশি হাত-পা ফুলে যায়, মুখে পানি আসে এই অবস্থাকে কোয়াশিয়রকর বলা হয়। সাধারণত ১-৪ বছরের শিশুরাই এর শিকার হয় ৷
এ ছাড়া প্রোটিন ও ক্যালরি উভয়েরই অভাব হলে ম্যারাসমাস দেখা যায়। এই ক্ষেত্রে শিশুর শরীর খুবই শুকিয়ে যায়। বৃদ্ধদের মতো চেহারা হয় ও বর্ধন ব্যাহত হয়।
প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে প্রোটিনের অভাব -
কাজ – আমাদের দেহে প্রোটিনের প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা কর।
আমাদের দৈনিক খাদ্যের বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানগুলোর মধ্যে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এই উপাদান অন্যান্য উপাদানের চেয়ে দামেও সস্তা। শরীরে তাপ ও শক্তি সরবরাহের জন্য গুরুত্ব বেশি।
কার্বোহাইড্রেটের গঠন –
সকল কার্বোহাইড্রেটই কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন এই তিনটি মৌলিক পদার্থের সবন্বয়ে গঠিত। এদের মধ্যে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের পরিমাণ সাধারণত ২ঃ১ অনুপাত অর্থাৎ এইগুলো পানিতে যে অনুপাতে থাকে কার্বোহাইড্রেটেও সেই অনুপাতে থাকে। তাই কার্বোহাইড্রেটকে হাইড্রেট অব কার্বন (Hydrate of carbon) বা কার্বনের পানি বলে। অর্থাৎ বলা যায় কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনযুক্ত কোনো পদার্থে যদি হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন ২ঃ১ অনুপাতে থাকে তবে ওই পদার্থকে সাধারণত কার্বোহাইড্রেট বলা হয়।
কার্বোহাইড্রেটের শ্রেণিবিভাগ – কার্বোহাইড্রেটকে প্রধানত ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা— -
(১) মনোস্যাকারাইড
(২) ডাইস্যাকারাইড
(৩) পলিস্যাকারাইড
১। মনোস্যাকারাইড–যে সব কার্বোহাইড্রেট একটি মাত্র সরল শর্করার অণু দিয়ে গঠিত এবং একে আর্দ্রবিশ্লেষিত করলে ক্ষুদ্রতম কোনো সরল শর্করার অণু পাওয়া যায় না তাকে মনোস্যাকারাইড বা এক- শর্করা বলে। যেমন- গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, গ্যালাকটোজ ।
(ক) গ্লুকোজ(Glucose) - এটি কার্বোহাইড্রেটের সবচেয়ে বেশি পরিচিত সরল হাইড্রোকার্বন। গ্লুকোজ পাওয়া যায়— দানা শস্যে, কিছু পরিমাণ মূলে, আঙুরে ও বিভিন্ন ফলে।
(খ) ফ্রুকটোজ (Fructose)- মধু, পাকা মিষ্টি স্বাদের ফলে এবং কিছু কিছু সবজিতে ফ্রুকটোজ - পাওয়া যায়।
(গ) গ্যালাকটোজ (Galactose) - দুধের চিনি (ল্যাকটোজ) ভেঙে গ্যালাকটোজ পাওয়া যায়। উদ্ভিদে
গ্যালাকটোজ পাওয়া যায় না । ২। ডাইস্যাকারাইড যেসব কার্বোহাইড্রেটকে আর্দ্রবিশ্লেষণ করলে ২টি মনোস্যাকারাইড বা সরল শর্করা পাওয়া যায় তাকে ডাইস্যাকারাইড বলে। যেমন— সুক্রোজ, ল্যাকটোজ ও মলটোজ ।
(ক) সুক্রোজ (Sucrose)- সাধারণ চিনি, আম, বিট, নানা প্রকার সবজি ও ফলের রসে সুক্রোজ পাওয়া যায়। সুক্রোজ ভাঙলে ১ অণু গ্লুকোজ ও ১ অণু ফ্রুকটোজ পাওয়া যায় ৷
সুক্রোজ
গুকোজ
+
ফ্রুকটোজ
(খ) ল্যাকটোজ (Lactose) - দুধে এই চিনি পাওয়া যায়। ল্যাকটোজকে ভাঙলে এক অণু গ্লুকোজ ও এক অণু গ্যালাকটোজ পাওয়া যায় ।
ল্যাকটোজ (দুধের চিনি)
গুকোজ
+
গ্যালাকটোজ
(গ) মলটোজ (Maltose) - স্টার্চ ভেঙে গ্লুকোজে পরিণত হওয়ার মধ্যবর্তী স্তরে মলটোজের উৎপত্তি হয়ে থাকে। মল্টোজ ভাঙলে দুই অনু গ্লুকোজ পাওয়া যায়।
মল্টোজ
গুকোজ
+
গুকোজ
৩। পলিস্যাকারাইড
যে সকল কার্বোহাইড্রেটকে আর্দ্রবিশ্লোষিত করলে অনেক একক মনোস্যাকারাইড পাওয়া যায়, তাকে পলিস্যাকারাইড বা বহু শর্করা বলা হয়। যেমন- (ক) স্টার্চ (খ) গ্লাইকোজেন ও (গ) সেলুলোজ । (ক) স্টার্চ (Starch) প্রাণিজগতের শক্তির প্রাথমিক উৎস হলো স্টার্চ বা শ্বেতসার। উদ্ভিদে - কার্বহাইড্রেট স্টার্চ হিসেবে সঞ্চিত হয়। এদের ভাঙলে অনেক গ্লুকোজ অণু পাওয়া যায়। চাল, গম, আলু, কচু ক্যাসাভা ইত্যাদি খাদ্যের অধিকাংশই স্টার্চ। দেহের মধ্যে এই স্টার্চগুলি এনজাইমের সাহায্যে আর্দ্রবিশ্লেষিত হয়ে গ্লুকোজ উৎপন্ন করে। প্রানিজগতে স্টার্চ পাওয়া যায় না ৷
স্টার্চ
-
গ্লুকোজ n
+
গ্লুকোজ n
এখানে, n - অনেক অণু
(খ) গ্লাইকোজেন (Glycogen) – প্রাণী দেহে সঞ্চিত কার্বোহাইডেটের নাম গ্লাইকোজেন। অনেক গ্লুকোজ অণুর সমন্বয়ে গ্লাইকোজেন হিসেবে প্রাণীর যকৃতে ও পেশিতে সঞ্চিত থাকে। উদ্ভিজ জগতে গ্লাইকোজেন পাওয়া যায় না। আমরা যখন অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকি বা কঠিন পরিশ্রম করি তখন গ্লাইকোজেন ভেঙে গ্লুকোজ তৈরি হয় এবং আমাদের প্রয়োজন মেটায়।
গ্লাইকোজেন
-
অনেক গ্লুকোজ অণু
(গ) সেলুলোজ (Cellulose ) - সেলুলোজ অনেক গ্লুকোজ অণুর সমন্বয়ে গঠিত। এই উপাদান কেবল উদ্ভিদে পাওয়া যায়, প্রাণিজগতে পাওয়া যায় না। খাদ্য শস্য যেমন- ধান, গম, যব, ছোলা এবং শাকসব্জি প্রভৃতির উপরের কঠিন অংশটা সেলুলোজ। মানবদেহে সেলুলোজ ভাঙার মতো এনজাইম না থাকায় আমাদের দেহ সেলুলোজকে ভাঙতে পারে না। তবে মল নিষ্কাশণে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
গুকোজ
গুকোজ
--সেলুলোজ--
গুকোজ
গুকোজ
কার্বোহাইড্রেটের খাদ্য উৎস- নিচে খাদ্যগুলোকে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ বেশি থেকে কম অনুযায়ী সাজানো
১। চিনি, গুড়, মিছরি, ক্যান্ডি, চকলেট, মিষ্টি ।
২। সাগু, এরারুট।
৩। চাল, ভুট্টা, যব, গম ।
৫। বিভিন্ন ধরনের শুকনা ফল যেমন- খেজুর, কিসমিস ইত্যাদি।
৬। বিভিন্ন ধরনের ডাল, সয়াবিন, বাদাম।
৭। টাটকা ফল, আঙ্গুর, কলা, আপেল, আম, আনারস ইত্যাদি।
৮। সবুজ শাকসবজি, যেমন- লালশাক বা পুঁইশাক, কলমি শাক, পালং শাক, বাঁধাকপি, পটোল, কুমড়া ইত্যাদি ।
দৈনিক প্রয়োজনীয় ক্যালরির ৫০-৬০ ভাগ কার্বোহাইডেট জাতীয় খাদ্য থেকে গ্রহণ করা উচিত ।
কার্বোহাইড্রেটের কাজ -
(১) দেহে তাপ বা শক্তি সরবরাহ করাই কার্বোহাইড্রেটের প্রধান কাজ। এজন্য একে জ্বালানি খাদ্য বলে। ১
গ্রাম কার্বোহাইডেট থেকে ৪ কিলো ক্যালরি শক্তি উৎপন্ন হয়।
(২) কার্বোহাইড্রেটসমূহ স্নেহ পদার্থ সহনে সহায়তা করে আমাদের কিটোসিস নামক রোগ হতে রক্ষা করে।
(৩) প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজ লবণ গ্রহণে সহায়তা করে।
(৪) অল্প প্রোটিনযুক্ত খাদ্যের প্রোটিনকে ভাগ উৎপাদনের কাজ থেকে বিরত রাখে, ফলে প্রোটিনের খরচ হয় না। কার্বোহাইড্রেটের এই কাজকে প্রোটিনের মিতব্যয়ী কাজ (Protein sparing action) বলা হয়।
(৫) কার্বোহাইড্রেটের উপস্থিতিতে এক প্রকার জীবাণু অন্ত্রে ভিটামিন 'কে' এবং ভিটামিন 'বি' উৎপন্ন করে ওই সমস্ত ভিটামিনের অভাব কিছুটা পূরণ করে থাকে ।
(৬) সেলুলোজ জাতীয় কার্বোহাইড্রেট কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
(৭) কার্বোহাইড্রেট যকৃৎকে ব্যাকটেরিয়া ঘটিত বিষক্রিয়া হতে রক্ষা করে।
(৮) মস্তিস্কের কাজ সচল রাখার জন্য একমাত্র জ্বালানি হিসেবে গ্লুকোজ জাতীর কার্বোহাইড্রেট-এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
খাদ্যে কার্বোহাইড্রেটের অভাবের ফল- -
(১) কার্বোহাইড্রেটের অভাবে দেহে তাপশক্তির ঘাটতি হয়। ফলে কাজ করার ক্ষমতা কমে যায়।
(২) আহারের সেলুলোজ জাতীয় কার্বোহাইড্রেটের অভাবে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয় ।
ফাজ - কোন ধরনের কার্বোহাইড্রেট বেশি উপকারী এবং কেন?
খাদ্যের ছয়টি উপাদানের মধ্যে স্নেহপদার্থ বা ফ্যাটই সবচেয়ে বেশি শক্তি উৎপন্ন করে। প্রায় সব প্রাকৃতিক খাদ্যবস্তুর মধ্যে এদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। স্নেহ জাতীয় পদার্থগুলোকে ভাঙলে ফ্যাটি এসিড ও গ্লিসারল পাওয়া যায় ৷
স্নেহপদার্থের শ্রেণিবিভাগ –
ক) স্নেহপদার্থের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শ্রেণিবিভাগ – স্নেহ পদার্থকে বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী দুই ভাগে ভাগ করা যায় ।
(১) কঠিনস্নেহ – যেসব স্নেহ পদার্থ স্বাভাবিকভাবে ও চাপে কঠিন আকৃতির হয় তাদেরকে কঠিনস্নেহ বলে । যেমন- প্রাণির চর্বি, মাখন ইত্যাদি ।
(২) তরলস্নেহ – যেসব স্নেহ পদার্থ স্বাভাবিক তাপে ও চাপে তরল অবস্থায় থাকে তাকে তরল স্নেহ বলে।
যেমন- সয়াবিন তেল, সরিষার তেল ইত্যাদি।
খ) উৎস অনুযায়ী শ্রেণিবিভাগ – উৎস অনুযায়ী স্নেহ পদার্থকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়—উদ্ভিজ্জস্নেহ ও প্রাণিজ স্নেহ
(১) উদ্ভিজ্জস্নেহ – যেসব স্নেহপদার্থ উদ্ভিজ জগৎ থেকে পাওয়া যায় তাদের উদ্ভিজ্জস্নেহ বলে। যেমন- নারিকেল তেল, সরিষার তেল ইত্যাদি।
(২) প্রাণিজস্নেহ – যে সকল স্নেহপদার্থ প্রাণিজগৎ থেকে পাওয়া যায় তাদের প্রাণিজস্নেহ বলে। যেমন- গরুর চর্বি, ঘি, মাখন, মাছের তেল ইত্যাদি।
খাদ্য উৎস –
(১) প্রথম শ্রেণির স্নেহ এখানে স্নেহের পরিমাণ ৯০%-১০০%। সয়াবিন তেল, ঘি, মাখন, সরিষার তেল, কড় মাছের তেল, শার্ক মাছের তেল ইত্যাদি।
(২) দ্বিতীয় শ্রেণির স্নেহ – এখানে স্নেহের পরিমাণ ৪০%-৫০%। বিভিন্ন ধরনের বাদাম, যেমন— চীনা বাদাম, কাজু বাদাম, পেস্তা বাদাম, আখরোট, নারিকেল ইত্যাদি।
(৩) তৃতীয় শ্রেণির স্নেহ এখানে স্নেহের পরিমাণ ১৫%-২০%। দুধ, ডিম, মাছ, মাংস, যকৃৎ ইত্যাদি। - আমাদের খাদ্যে দৈনিক ক্যালরির ২০%-২৫% স্নেহপদার্থ থেকে গ্রহণ করা উচিত।
স্নেহপদার্থের কাজ -
১। স্নেহপদার্থের প্রধান কাজ হলো তাপ ও শক্তি সরবরাহ করা। ১ গ্রাম স্নেহপদার্থ থেকে দেহে ৯ কিলোক্যালরি শক্তি উৎপন্ন হয়। দেহে শক্তির উৎস হিসেবে জ্বালানিরূপে সঞ্চিত থাকে ।
২। কোষ প্রাচীরের সাধারণ উপাদান হিসেবে কোলেস্টেরল ও ফসফোলিপিড জাতীয় স্নেহ পদার্থ গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করে।
৩। ভিটামিন এ, ডি, ই ও কে— কে দ্রবীভূত করে দেহের গ্রহণ উপযোগী করে তোলে ৷
8। দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোকে সংরক্ষণের জন্য স্নেহপদার্থের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
৫। দেহ থেকে তাপের অপচয় রোধ করে শরীর গরম রাখে।
৬। স্নেহপদার্থ প্রয়োজনীয় ফ্যাটি এসিড সরবরাহ করে চর্মরোগের হাত থেকে রক্ষা করে ।
অভাবজনিত ফল –
১। স্নেহজাতীয় খাদ্যের অভাবে চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিনের অভাব দেখা যায় ।
২। ত্বক শুকনো ও খসখসে ভাব ধারণ করে। অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিডের অভাবে শিশুদের দেহে একজিমা দেখা দিতে পারে।
দীর্ঘদিন গবেষণা করে লক্ষ করা গেছে যে আমাদের প্রকৃতিজাত খাদ্যে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফ্যাট ছাড়াও এমন কিছু রাসায়নিক উপাদান রয়েছে যার অভাবে বিভিন্ন ধরনের রোগ যেমন- বেরিবেরি, রাতকানা, রিকেট, এনিমিয়া ইত্যাদি রোগ দেখা যায় এবং নির্দিষ্ট রোগের জন্য নির্দিষ্ট কিছু উপাদান গ্রহণে তা ভালো হয়ে যায়। এই উপাদানগুলো হচ্ছে ভিটামিন। অর্থাৎ ভিটামিন বা খাদ্যপ্রাণ হচ্ছে খাদ্যের মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন প্রকার জটিল জৈব রাসায়নিক যৌগ যা জীবদেহে খুব সামান্য পরিমাণে প্রয়োজন হয় কিন্তু এদের উপস্থিতি ছাড়া জীবদেহের শক্তি উৎপাদন ক্রিয়া ব্যাহত হয় ও সুষ্ঠু সাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশ সম্ভব হয় না এবং এই যৌগগুলোর অভাবে বিভিন্ন ধরনের রোগ দেখা যায়। দেহে এই অত্যাবশ্যকীয় উপাদানটার চাহিদা কিন্তু খুব সামান্য। কিন্তু এর কাজকে সামান্য বলা যায় না। কারণ দেহ গঠন, ক্ষয়পুরণ, বৃদ্ধিসাধন, তাপ ও শক্তি উৎপাদন, অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ প্রতিটি কাজই ভিটামিনের উপস্থিতি ছাড়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারে না।
ভিটামিনের শ্রেণিবিভাগ – দ্রবণীয়তার উপর ভিত্তি করে ভিটামিনগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
১) চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন – যে ভিটামিনগুলো চর্বিতে বা চর্বি দ্রাবকে দ্রবীভূত হয় কিন্তু পানিতে অদ্রবণীয় তাদের চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন বলে। এই ভিটামিন ৪ টি, যথা- এ, ডি, ই, ও কে।
২) পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন – যে ভিটামিনগুলো পানিতে খুব সহজেই দ্রবীভূত হয় কিন্তু চর্বিতে অদ্রবণীয় তাকে পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন বলে।
পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন প্রধানত ২টি। ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স ও ভিটামিন-সি।
ভিটামিনের কাজ -
কাজ - আমাদের দেহের জন্য স্নেহপদার্থ কেন প্রয়োজন বর্ণনা কর।
কাজ – মানবদেহে ভিটামিন কী কী কাজ করে লেখ ৷
ভিটামিন ‘এ’
ভিটামিন-এ চর্বিতে দ্রবণীয় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন। ভিটামিন এ-এর রাসায়নিক নাম রেটিনল । এটি বর্ণহীন ও তাপে কম নষ্ট হয়। তবে উচ্চ তাপে ও অতিবেগুনি রশ্মিতে নষ্ট হয়।
ভিটামিন এ'র কাজ-
চোখের স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি বজায় রাখার জন্য এই
বিভিন্ন গ্রন্থিকে স্বাভাবিক ও কর্মক্ষম রাখে।
বিভিন্ন সংক্রামক রোগের আক্রমণ রোধ করে।
ভিটামিন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে ।
জীবদেহের সার্বিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে।
ত্বক ও ঝিল্লির কোমলতা ও সজীবতা রক্ষা করে।
রাতের বেলায় বা অন্ধকারে অল্প আলোতে দেখতে ভিটামিন-এ সহায়তা করে ৷
খাদ্য উৎস – ভিটামিন এ এর উৎসকে ২ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
(১) প্রাণিজ উৎস – ভিটামিন এ প্রাণিজ খাদ্যে এবং কোনো কোনো প্রোটিনের সাথে যুক্ত অবস্থায় পাওয়া - যায়। ডিম, কলিজা, চর্বিযুক্ত মাছ, সামুদ্রিক মাছ এর কলিজায়, হ্যলিবার্ট ও শার্ক ইত্যাদি মাছের তেল, ইলিশ মাছ, ইত্যাদিতে পাওয়া যায়। দুধে বিশেষ করে কোলেস্ট্রামে যথেষ্ট ভিটামিন এ থাকে।
(২) উদ্ভিজ্জ উৎস – উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশে হলুদ, কমলা বা হলদে-কমলা বর্ণের এক ধরনের রাসায়নিক যৌগ বা রঞ্জক পদার্থ থাকে, যেগুলো খাওয়ার পর মানবদেহে ভিটামিন-এ, তে রুপান্তরিত হয়। এদের ক্যারটিন বা প্রাক ভিটামিন-এ বলে। সবুজ বা রঙিন শাক সবজি, হলুদ ফলমুল, মিষ্টি কুমড়া, গাজর, মিষ্টি আলু, পাকা পেঁপে, পাকা আম, পাকা কাঁঠাল ইত্যাদিতে প্রাক ভিটামিন-এ বিদ্যমান ।
অভাবজনিত লক্ষণ
১) ভিটামিন এ এর অভাবে রাতকানা রোগ দেখা দেয়। এই রোগ হলে রাতের বেলায় অল্প আলোতে বা অন্ধকারে দেখার অসুবিধা ঘটে।
২) এ ছাড়া ভিটামিন-এ এর অভাবে চোখের ঝিল্লি শুষ্ক হয়ে প্রদাহ দেখা দেয়, যাকে জেরোপথ্যালমিয়া বলে। ৩) ভিটামিন এ-এর অভাবে চোখের পর্দার অস্বচ্ছতাও হতে পারে। একে কেরাটোম্যালেসিয়া বলে।
৪) এই ভিটামিনের অভাবে চামড়ার শুষ্কতা হতে পারে।
ভিটামিন-এ'র অভাবে সৃষ্ট চোখের বিভিন্ন রোগ
৫) রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা হ্রাস পায়।
৬) ভিটামিন-এ এর ঘাটতি হলে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় ৷
ভিটামিন—'ডি'
ভিটামিন-ডি এর রাসায়নিক নাম ক্যালসিফেরোল। এটা রিকেট রোগ প্রতিরোধ করে বলে এই ভিটামিনকে রিকেট রোগ প্রতিরোধক ভিটামিন বলে। এটা চর্বিতে দ্রবণীয় কিন্তু পানিতে দ্রবণীয় নয়। তাপে নষ্ট হয় না ।
ভিটামিন-ডি এর কাজ -
উৎস –
অভাবজনিত রোগ –
১) রিকেট – ভিটামিন-ডি এর অভাবে শিশুদের রিকেট হয়। এই রোগে নিচের লক্ষণগুলো দেখা যায়-
শিশুর হাড় নরম ও অপরিণত হওয়ার ফলে শরীরের বৃদ্ধি হয় না। • পায়ের হাড়গুলো বেঁকে ধনুকের মতো আকৃতির হয়।
২) অস্টিওম্যালেসিয়া -এই রোগ গর্ভবতী ও স্তন্যদাত্রী মা ও বয়স্কদের হয়। এর লক্ষণগুলো হলো-
কাজ – ভিটামিন-এ ও ডি এর অভাবে আমাদের দেহে কী ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ভিটামিন ‘ই’
ভিটামিন-ই এর আর এক নাম টোকোফেরল। এটি চর্বিতে দ্রবণীয় ও পানিতে অদ্রবণীয় একটা ভিটামিন।
উৎস – ভোজ্য তেল যেমন- সয়াবিন তেল, গমের জার্ম তেল ভিটামিন-ই-এর সবচেয়ে ভালো উৎস। গমের অংকুর, অংকুরিত ছোলা, মটরশুঁটি ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এ ছাড়া শাকসবজি, ফল, যকৃৎ, ডিমের কুসুম, দুধ ইত্যাদিতে ভিটামিন-ই পাওয়া যায় ৷
ভিটামিন-ই এর কাজ-
অভাবজনিত অবস্থা -
কাজ – ভিটামিন-ই আমাদের দেহে কী ধরনের কাজ করে লেখ।
ভিটামিন-কে
এর রাসায়নিক নাম ফাইটাল ন্যাপথোকুইনোন। একে রক্তক্ষরণ নিবারক ভিটামিন বা অ্যানটি হেমারেজিক ভিটামিনও বলা হয়। এটি হলুদ বর্ণের, চর্বিতে দ্রবণীয় এবং পানিতে অদ্রবণীয় একটা ভিটামিন। তাপে, বাতাসে ও আর্দ্রতায় ভিটামিন-কে নষ্ট হয় না, তবে আলোতে নষ্ট হয়ে যায়। ভিটামিন-কে খুব কম নষ্ট হয় ।
উৎস – উদ্ভিদের সবুজ পাতা ও গাঁজানো খাবারে ভিটামিন-কে পাওয়া যায়। সবুজ রঙের শাক, ডিমের কুসুম, সয়াবিন তেল এবং যকৃতে ভিটামিন-কে পাওয়া যায়। লেটুস পাতা, পালং শাক, টমেটো, শালগম পাতা, ফুলকপি ও বাঁধাকপিতে ভিটামিন কে পাওয়া যায়। প্রাণীজ উৎসের মধ্যে সামুদ্রিক মাছ, ডিমের কুসুম, মাংস, যকৃৎ, পনির, দুধ ও দুধ-জাতীয় খাদ্যে ভিটামিন-কে থাকে।
ভিটামিন-কে এর কাজ-
অভাবজনিত ফল –
কাজ – ভিটামিন কে এর অভাবে আমাদের দেহে কী ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ভিটামিন 'বি' কোনো একক ভিটামিন না। প্রায় ১৫টি বিভিন্ন ভিটামিনকে একসাথে ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স বলা হয়। এর মধ্যে নিচে উল্লেখযোগ্য ৬ টি বি-ভিটামিনের নাম দেওয়া হলো ।
ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স
থায়ামিন বা ভিটামিন বি,
রিবোফ্লাভিন বা ভিটামিন বি,
নায়াসিন
ভিটামিন-বি
ভিটামিন বি
ভিটামিন বি,
ফলিক এসিড
ভিটামিন-বি১
এর রাসায়নিক নাম থায়ামিন। এই ভিটামিন পানিতে দ্রবণীয় ও বেশি তাপে নষ্ট হয়ে যায়। খাদ্যদ্রব্য বেশি ধুলে এবং অনেক বেশি তাপে বেশি সময় ধরে রান্না করলে বি১ নষ্ট হয়ে যায় ৷
ভিটামিন-বি, এর কাজ
থায়মিনের প্রধান কাজ হলো কার্বোহাইড্রেট বিপাকে অংশগ্রহণ করে শক্তি মুক্ত করে।
স্বাভাবিক ক্ষুধা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
খাদ্য উৎস -
স্নায়ুতন্ত্রকে সক্রিয় রাখে ।
হৃদপিন্ডের স্বাভাবিক কাজ নিয়ন্ত্রণ করে।
খাদ্য উৎস -
উদ্ভিজ উৎস – ঢেঁকিছাঁটা চাল, আটা, ছোলার ডাল, বাদাম, সয়াবিন, মটর ডাল, আলু ইত্যাদি। প্রাণিজ উৎস – যকৃৎ, হূৎপিন্ড, বৃক্ক, ডিম, দুধ ইত্যাদি ।
অভাবজনিত অবস্থা -
ক) থায়ামিনের অল্প ঘাটতি হলে যে লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়-
শারীরিক ও মানসিক অবসাদ
খিটখিটে মেজাজ
অনিদ্রা
ক্ষুধামন্দা
ওজন হ্রাস ও দুর্বলতা
বুক ধড়ফড় দেখা দেয়
খ) থায়ামিনের খুব বেশি অভাব হলে আমাদের দেহে বেরিবেরি নামক রোগের সৃষ্টি হয়। বেরিবেরি ২ ধরনের হয়। যথা – ভিজা বেরিবেরি ও শুকনা বেরিবেরি।
বেরিবেরি লক্ষণগুলো হলো
কাজ – ভিটামিন-বি১ এর অভাবে আমাদের দেহে কী ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে তা দলীয়ভাবে উপস্থাপন কর।
ভিটামিন-বি
ভিটামিন-বি২ এর রাসায়নিক নাম রিবোফ্লাভিন। হালকা হলুদ বর্ণের ও তাপে সহনশীল।
ভিটামিন-বি২ এর কাজ-
উৎস -
ক) প্রাণিজ উৎস - দুধ এই ভিটামিনের উৎকৃষ্ট উৎস। এ ছাড়া কলিজা, পনির, ডিম, মাছ, মাংস ও বৃক্ক উল্লেখযোগ্য।
খ) উদ্ভিজ উৎস – উদ্ভিজ উৎসের মধ্যে শাকসবজি, ডাল, শিম ও অংকুরিত শস্যে পাওয়া যায়।
অভাবজনিত অবস্থা -
কাজ – ভিটামিন-বি২ এর অভাবজনিত সমস্যাগুলো বর্ণনা কর।
উদ্ভিজ উৎস – আমলকী, পেয়ারা, আমড়া, লেবু, টমেটো, কমলালেবু, তাজা শাকসবজি, ধনেপাতা, বাঁধাকপি, কামরাঙ্গা ইত্যাদি ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি পাওয়া যায়।
প্রাণীজ উৎস- প্রাণিজ উৎসে ভিটামিন-সি কম পাওয়া যায়। মায়ের দুধে ভিটামিন-সি বিদ্যমান ।
কার্যকারিতা -
অভাবের ফল – ভিটামিন-সি এর গুরুতর অভাবে স্কার্ভি রোগ হয়। যে কোনো বয়সেই এই স্কার্ভি রোগ হতে পারে। এই রোগের লক্ষণগুলো হলো-
কাজ - আমাদের দেহে ভিটামিন-সি এর ঘাটতি হলে কী ধরনের অভাবজনিত লক্ষণ দেখা দেয় তা বোর্ডে লেখ।
শরীর গঠনে প্রোটিনের পরেই খনিজ পদার্থ বা ধাতব লবণের স্থান। দেহের উপাদানের প্রায় শতকরা ৯৬ ভাগ জৈব পদার্থ এবং ৪ ভাগ অজৈব পদার্থ বা খনিজ পদার্থ। দেহে প্রায় ২৪ প্রকার বিভিন্ন খনিজ পদার্থ রয়েছে। ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ক্লোরিন, ম্যাঙ্গনেশিয়াম, লৌহ, ম্যাঙ্গানিজ, তাম্র, আয়োডিন, দস্তা, এলুমিনিয়ম, নিকেল ইত্যাদি খনিজ পদার্থ দেহের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য এগুলো খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হয়। কোনো খাদ্যবস্তু পোড়ালে যে সাদা ছাই অবশিষ্ঠ থাকে, তাকে খনিজ পদার্থ বা অজৈব লবণ বলে। পরিমাণের মাপকাঠিতে এদের ২ ভাগে ভাগ করা যায় ৷
(১) প্রধান খনিজ লবণ – অজৈব পদার্থের মধ্যে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাঙ্গনেসিয়াম, ও গন্ধক প্রাণী দেহে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অবস্থান করে। এদের প্রধান খনিজ লবণ বলে ।
(২) লেশমৌল খনিজ লবণ – লৌহ, আয়োডিন, ক্লোরিন, জিংক, ম্যাঙ্গানিজ, তাম্র, কোবাল্ট, মলিবডেনাম ইত্যাদি খুব সামান্য পরিমাণ দেহের পুষ্টি কাজে অংশ নেয় বলে এসব মৌলকে লেশমৌল বলা হয়। কিন্তু এগুলো খুব সামান্য পরিমাণে প্রয়োজন হলেও এদের কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
খনিজ পদার্থের কাজ
আমরা এখন ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ, আয়োডিন, জিংক, সোডিয়াম ও পটাশিয়াম নিয়ে আলোচনা করব। ক্যালসিয়াম- খনিজ লবণের মধ্যে দেহে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। দেহের ১৯% ক্যালসিয়াম দাঁতে এবং হাড়ে এবং ১% থাকে রক্তে এবং দেহের জলীয় অংশে ও কোমল তত্তুতে ।
উৎস-
ক) প্রাণিজ উৎস – দুধ ক্যালসিয়ামের উৎকৃষ্ট উৎস। দুগ্ধজাত খাদ্য যেমন- দই, ছানা, পনির, মাওয়া, কাটাসহ ছোট মাছ ও হাড়ে ক্যালসিয়াম থাকে ।
খ) উদ্ভিজ উৎস – সবুজ শাকসবজি, লবণ, কলমি শাক, ডাঁটা শাক, পুঁইশাক, লালশাক, ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম থাকে। সবজির মধ্যে ঢেঁড়শ, ধুন্দুল, বাঁধাকপি, ফুলকপি, শিম ইত্যাদি সবজি, ছোলা, মাষকলাই, মুগ, ও সয়াবিনে ক্যালসিয়াম থাকে।
কার্যকারিতা -
অভাবের ফল -
রিকেটস্
রিকেটস্ এ আক্রান্ত শিশুর পায়ের এক্স-রে এর চিত্র
ক্যালসিয়ামের অভাবে অস্টিওম্যালেসিয়া পা
ফসফরাস -দেহের খনিজ উপাদানগুলোর মধ্যে ক্যালসিয়ামের পরেই ফসফরাসের স্থান। আমাদের দেহে - জৈব ও অজৈব এই দুই ধরনের যৌগ হিসেবে ফসফরাস বিদ্যমান।
উৎস- প্রাণিজ উৎসের মধ্যে দুধ, ডিম, মাংস, যকৃৎ, মাছ এবং উদ্ভিজ উৎসের মধ্যে শাকসবজি, ডাল, ঢেঁকি ছাঁটা সিদ্ধ চাল, মটরশুঁটি, ফুলকপি, গাজর ইত্যাদিতে ফসফরাস পাওয়া যায় ।
কার্যকারিতা -
অভাবজনিত অবস্থা – সাধারণত ফসফরাসের অভাব খুব একটা দেখা যায় না ।
কাজ - ক্যালসিয়ামের অভাবে আমাদের দেহে কী ধরনের অভাবজনিত লক্ষণ দেখা দেয় তা বোর্ডে লেখ ।
লৌহ
একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির দেহে ৩-৫ গ্রাম লৌহ থাকে। মানুষের দেহের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ লেশমৌল। মোট লৌহের দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৬৫% লৌহ রক্তের হিমোগ্লোবিন অণুতে বর্তমান থাকে। প্রায় ৫% পেশিতে থাকে।
উৎস –
প্রাণিজ উৎস - যকৃৎ, বৃক্ক ও হূৎপিন্ডে লৌহ থাকে। দুধে সামান্য পরিমাণে পাওয়া যায় ।
উদ্ভিজ্জ উৎস – সবুজ শাকসবজি, ডাল, শস্য, আপেল, গুড়, শুকনা ফলে যথেষ্ট পরিমাণে লৌহ থাকে।
কার্যকারিতা -
অভাবজনিত লক্ষণ – খাদ্যে দীর্ঘদিন লৌহের অভাব ঘটলে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে যায়। ফলে -
কাজ – লৌহের অভাবে আমাদের দেহে কী ধরনের অভাবজনিত লক্ষণ দেখা দেয় তা দলীয়ভাবে উপস্থাপন কর।
আয়োডিন
মানুষের দেহে আয়োডিনের পরিমাণ ১২-১৫ মিলিয়াম। শরীরের পুষ্টির জন্য আয়োডিন একটি অত্যাবশ্যকীয় লেশমৌল। দুই-তৃতীয়াংশ আয়োডিন থাকে থাইরয়েড গ্রন্থিতে।
উৎস – সামুদ্রিক মাছ, সমুদ্রের তীরবর্তী এলাকার শাকসবজি ও পশুর মাংসে পাওয়া যায়।
কার্যকারিতা -
আয়োডিন দেহে থাইরয়েড গ্রন্থিতে থাইরক্সিন হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে। আয়োডিন যুক্ত এই হরমোন
মানবদেহে বিভিন্ন কাজ করে থাকে। যেমন—
অভাবজনিত সমস্যা- খাদ্যে আয়োডিনের ঘাটতি থাকলে যে সমস্যাগুলো হয় তা হলো— -
(১) গলগন্ড বা গয়টার – আয়োডিনের অভাব হলে গলগন্ড হয়। এই রোগে আয়োডিনের অভাবে থাইরয়েড - গ্রন্থি থেকে থাইরক্সিন হরমোন তৈরি হতে পারে না। ফলে থাইরয়েড গ্রন্থি হরমোন তৈরির জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম করে বলে গ্রন্থিটি বড় হয়ে যায়। ফলে বাইরে থেকে গলা ফুলা দেখা যায়। এ ছাড়া এই রোগে বুদ্ধি ও চলনশক্তি হ্রাস, মানসিক অক্ষমতা, তোতলামি, মাংসপেশির সংকোচন, স্নায়বিক দুর্বলতা এসব লক্ষণ প্রকাশ পায় ।
(২) হাইপোথাইরয়েডিজম -থায়রয়েড গ্রন্থির কর্ম ক্ষমতা হ্রাস দেহের প্রয়োজন অনুযায়ী থাইরক্সিন হরমোন তৈরি না হলে এই অবস্থাকে হাইপোথাইরয়েডিজম বলে। এর লক্ষণ হলো- আলসেমি, শুকনাচামড়া, ঠান্ডা সহ্য করতে না পারা, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি। এর প্রভাবে ছোট শিশুরা মানসিক প্রতিবন্ধীতে পরিণত হয়।
(৩) ক্রেটিনিজম (হাবাগোবা ও বামনত্ব দেখা দিতে পারে।
কাজ - আয়োডিনের অভাবজনিত লক্ষণ সম্পর্কে দেখ ।
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য পানি অত্যাবশ্যকীয়। মানুষ কয়েক সপ্তাহ খাবার না খেয়েও বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু পানি না খেয়ে এক দিনের বেশি থাকতে পারে না। মানুষের দেহ ৫৫-৭৫% পানি যারা গঠিত। শরীরের সকল টিসুতেই পানি থাকে। প্রতিদিন মল, মূত্র, ফুসফুস ও চামড়ার মাধ্যমে শরীর থেকে পানি বের হয়ে যায় এবং মানুষের দেহ পানি সঞ্চয় করে রাখতে পারে না। তাই প্রতিদিনই বিশুদ্ধ পানি পান করতে হয়। কী পরিমাণ পানি পান করতে হবে তা নির্ভর করে কী ধরনের শারীরিক পরিশ্রম করা হচ্ছে, কী খাবার খাওয়া হচ্ছে ইত্যাদি বিষয়ের উপর। প্রতিদিন যে পরিমাণ পানি শরীর থেকে বেরিয়ে যায় সেই পরিমাণ পানি পান করা প্রয়োজন। খাবার থেকে প্রায় ১ লিটার পানি পাওয়া যায় এবং বাকিটা প্রতিদিনের গ্রহণকৃত তরল ও পানীয় থেকে পেতে হবে। গড়ে একজন মানুষের প্রতিদিন ২.৫-৩ লিটার পানি শরীর থেকে বের হয়ে যায়। একজন স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের দিনে ৬-৮ গ্লাস পানির প্রয়োজন হয়। তবে পানির চাহিদা নিম্নলিখিত অবস্থায় বেড়ে যায়-
পানির উৎস – পানির প্রধান উৎস হচ্ছে খাবার পানি, ডাবের পানি, দুধ, ফলের রস, সুপ ইত্যাদি বিভিন্ন
ধরনের পানীয়। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের রসাল ফল, যেমন- তরমুজ ইত্যাদিতেও প্রচুর পরিমাণে পানি থাকে ।
পানির কাজ-
অভাবজনিত অবস্থা – শরীরে পানির পরিমাণ খুব কমে গেলে সেই অবস্থাকে ডিহাইড্রেশন বা পানি শুষ্কতা
বলে।
ডিহাইড্রেশনের কারণগুলো হলো—
ডিহাইড্রেশনের লক্ষণগুলো হলো -
ডিহাইড্রেশন থেকে শরীরে মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। তাই ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি গ্রহণ করা দরকার।
কাজ - আমাদের দেহে প্রতিদিন কী পরিমাণ পানির প্রয়োজন হয়? কোন কোন অবস্থায় পানির চাহিদা বৃদ্ধি পায় তা লেখ।
আরও দেখুন...